আপনিও ভাবছেন যে জৈব কৃষি শুরু করবেন? কিভাবে কি করবেন জানেন না? সেই সম্পর্কে আপনার বেশি জ্ঞান ও নেই? ভয় পাওয়ার কিছু নেই আমাদের এই নিবন্ধ আপনাকে সে সম্পর্কে সবদিক থেকে সাহায্য করবে।
বর্তমান সময়ে বহু কৃষক এই পুরনো পদ্ধতির আবার ব্যবহার শুরু করেছে, যার অনেক ভালো ফল দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে ভালো ভাবে বাঁচার ও পুষ্টিকর খাবার পাওয়ার একমাত্র উপায়ই হল এই অর্গানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষি পদ্ধতি।
তো আমরা এই নিবন্ধের মাধ্যমে আজকে অর্গানিক ফার্মিং এর বিভিন্ন কৌশল ও কীভাবে করা যায় সে সম্পর্কে ভালো করে জানতে পারবো, তাই বেশি দেরি না করে আমাদের মূল বিষয়টি শুরু করা যাক।
জৈব কৃষি কী?
জৈব কৃষি বা অর্গানিক ফার্মিং পদ্ধতি হলো এক ধরনের পরিবেশ বান্ধব কৃষি পদ্ধতি যেখানে কোনরকম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়ে থাকে না, তার বদলে প্রাকৃতিক পদার্থের ব্যবহার হয়। এই পদ্ধতিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপাদান যেমন কম্পোস্ট, গোবর সার, জৈবিক কীটনাশক ইত্যাদি এর সাহায্যে ফসল ফলানো হয়। তার ফলে মাটির কোনরকম ক্ষতি হয় না, পরিবেশ দূষণ ঘটে না, ভৌম জল শুদ্ধ থাকে এবং উপরন্তু যা যা ফসল উৎপাদিত হয় তা অনেক টাটকা ও পুষ্টিকর হয়।
জৈব কৃষি এর কৌশল কী কী? | Organic Farming Methods
জৈব চাষ সম্পর্কে তো জানা হল এবারে জানার বিষয় হল এই জৈব চাষ কিভাবে করা যেতে পারে, কোন কোন পদ্ধতি এতে ব্যবহার হয়। মূলত প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করা হয় এই পদ্ধতিতে তবে দরকার মতো কিছু ক্ষেত্রে রাসায়নিক জিনিসের ব্যবহার ও করা হয়ে থাকে। নিচে জৈব কৃষি এর কিছু কৌশল বা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করা হল –
১. জৈব সার
যেকোনো চাষ করতেই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি জিনিস হলো সার, এখানে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করা হয় যা থেকে কোন ক্ষতি হয় না। যেমন গোবর সার, কম্পোস্ট সার, কেঁচো সার ইত্যাদি হল এর প্রকৃত উদাহরণ যা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি সার। এই জৈব সার গুলিকে আপনি খুব সহজেই বাড়িতে তৈরি করতে পারবেন বাইরে থেকে ক্রয় করার প্রয়োজন পড়বে না যার ফলে আপনার ব্যয় কমবে।
২. জৈবিক কীটনাশক
জৈব সার দেওয়ায় ভালোভাবে ফসল তো উৎপন্ন হল কিন্তু এই ফসলকে রক্ষা করার জন্য কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। এবার এই কীটনাশকও তৈরি করা হয় প্রাকৃতিক উপাদান থেকে যা উৎপাদিত ফসলের পুষ্টিগুণ কে কম করেনা। যেমন নিম গাছের পাতা ও ছাল থেকে তৈরি তেল আবার লঙ্কার গুঁড়ো জলের মধ্যে গুলে গাছের মধ্যে তার স্প্রে করলে কীটনাশের মত কাজ করে থাকে।
৩. আন্তঃ ফসল চাষ
যদি একটি জমির মধ্যে একই সাথে বিভিন্ন ধরনের ফসলকে উৎপাদন করা হয় তখন তাকে আন্তঃ ফসল চাষ বলা হয়। এই চাষের ফলে এক দিকে যেমন অনেক ধরনের ফসল উৎপাদিত হয় পাশাপাশি এতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হয় এবং বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড় এর আক্রমণকেও কমিয়ে দেয়। যেমন একসাথে ফসলের পাশাপাশি শাক ও ডাল জাতীয় শস্য, আবার নিচে সবজি চাষ ও উপরে মাচা করে গুল্ম জাতীয় অন্য সবজি চাষ করা হয়।
৪. জল সংরক্ষণ
দিন দিন ভৌম জলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে বা এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে ভৌম জল অনেক নিচে তাই সেসব অঞ্চলে জল সেচের সাহায্য নেওয়া হয়। কিন্তু কিন্তু মনে রাখতে হবে জলসেচ করতে হবে পরিমাণ মতন এবং সেই জল সময় মতো ধরে রাখার ও নিকাশের সুবন্দোবস্ত রাখতে হবে। যেহেতু জৈব কৃষি তাই এতে ক্ষতিকর উপাদান থাকে না ফলে ব্যবহৃত জল পরবর্তীতে মাটির মধ্যে প্রবেশ করে ভৌমজলের স্তরকেও বাড়িয়ে তোলে।
৫. বীজ সংরক্ষণ
উচ্চ ফলনশীল বীজে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ যেমন বেশি হয় তা থেকে ছড়ানো রোগের পরিমাণও অনেকটাই বেশি হয়। তাই কৃষকরা নিজেদের উৎপাদিত ফসল থেকেই বীজ সংগ্রহ করে এবং পরবর্তীকালে সেই বীজটিকে ব্যবহার করে। এই স্থানীয় জাতের যে বীজ হয় সেগুলি ব্যবহার করাতে মাটি অনুর্বর হয় না ও উৎপাদিত ফসল ভালো হয়।
৬. ফসল আবর্তন
একই জমিতে একই ফসল বারবার না ফলিয়ে যদি আলাদা আলাদা ফসল ফলানো যায় তখন তাকে শস্য আবর্তন বা ফসল আবর্তন বলা হয়। এই শস্যাবর্তন এর অনেক গুনাগুন আছে, একই ফসল বারবার চাষের ফলে মাটি যে মৌলগুলিকে হারিয়ে ফেলে তা অন্য চাষের ফলে পুনরায় ফিরে আসে। সেই জন্য বর্তমানে জমি কখনো ফেলে রাখা হয় না কিছু না কিছু চাষ সে জমিতে করা হয়ে থাকে কখনো রবি বা কখনো খারিফ শস্য।
৭. সেঁড়া জাতীয় ফসল
মাটির প্রধান তিনটি উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান হলো নাইট্রোজেন যা প্রত্যেক উদ্ভিদ কম বা বেশি পরিমাণে নিয়ে থাকে। এবারে এই নাইট্রোজেনের মাত্রাকে বজায় রাখার জন্য জমিতে বিভিন্ন ডাল জাতীয় শস্য যেমন শিম, মটর, কলাই ইত্যাদি চাষ করা হয় । এই সেঁড়া জাতীয় উদ্ভিদগুলির মূলের মধ্যে নাইট্রোজেন সংগ্রহকারী জীবাণু বাস করে, সেই জীবাণু গুলি মারা গেলে নাইট্রোজেন মাটিতে পুনরায় ফিরে যায়।
জৈব কৃষির উপকারিতা
এর উপকারিতা প্রচুর বলতে শুরু করলে বলতেই থাকা হবে, তাই এর কিছু প্রধান উপকারিতা গুলি নিচে আলোচনা করা হলো-
স্বাস্থ্যকর খাদ্য: রাসায়নিক প্রভাবমুক্ত ফসল উৎপাদিত হওয়ায় স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই পুষ্টিকর ও উপকারী
মাটির উন্নতি: জৈব সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে।
জীব বৈচিত্র: ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার হয় না বলে মাটিতে বসবাসকারী জীব থেকে শুরু করে ফসল ভক্ষণকারী জীবের কোনো রকম ক্ষতি হয় না যার ফলে জীববৈচিত্র বজায় থাকে।
পরিবেশবান্ধব: জৈব কৃষি জল মাটি বায়ু কোনরকম দূষণ ঘটায় না এটি একটি পরিবেশ বান্ধব কৃষি পদ্ধতি এবং ভবিষ্যতে এই কৃষি পদ্ধতি আরও অনেক এগিয়ে যাবে।
আরো পড়ুন:
FAQs. জৈব কৃষির কৌশল | Organic Farming Methods
১. জৈব কৃষি মডেল কি?
জৈব কৃষি হল একটি সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা যা জীববৈচিত্র্য, জৈবিক চক্র এবং মাটির জৈবিক কার্যকলাপ সহ কৃষি-বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে উৎসাহিত করে। অনেক গবেষণাযর মাধ্যমে দেখা গেছে যে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করলে এই জৈব চাষ পদ্ধতি প্রচলিত পদ্ধতির চেয়েও বেশি ফলন দিতে পারে।
২. জৈব চাষ প্রযুক্তি কি?
জৈব চাষ রাসায়নিক সার এবং কৃত্রিম কীটনাশক ব্যবহারকে সীমিত করে, সাথে এটি শস্য আবর্তন, জৈব সার, কম্পোস্ট, জৈবিক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহারকে উৎসাহিত করে।
৩. জৈব চাষ কয় ধরনের হয় ও কি কি?
জৈব চাষ দুই প্রকারের হয়, যথা – বিশুদ্ধ জৈব চাষ এবং সমন্বিত জৈব চাষ।
বিশুদ্ধ জৈব চাষ – এই পদ্ধতিতে সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়ে থাকে কোনরকম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয় না।
সমন্বিত জৈব চাষ – এই পদ্ধতিতে পরিবেশগত মান এবং অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের কথা মাথায় রেখে জৈবিক ও কৃত্রিম দুই ধরনের পদার্থ ব্যবহার করা হয় সমন্বিত হবে।
৪. ধাপে ধাপে কৃষিকাজ কিভাবে করবেন?
খুব সহজে আপনি কিভাবে কৃষিকাজ করতে পারবেন তার জন্য নিচে ৭টি প্রধান ধাপ উল্লেখ করা হলো:
মাটি তৈরি: যে মাটিতে চাষ হবে সেটিকে ভালো করে লাঙ্গল দিয়ে সমতলীকরণ করে নিতে হবে।
বপন: ভালো মানের ফসলের বীজ নির্বাচন করে তা বপন করতে হবে মাটিতে।
পুষ্টি যোগ করা: মাটির পরীক্ষা করে মাটিতে কি ধরনের মৌলের প্রয়োজন সেই মতো সার প্রয়োগ করতে হবে।
জল সেচ: চাহিদা অনুযায়ী জলে যোগান দিতে হবে দরকার পড়লে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
গাছপালা রক্ষা: পোকার হাত থেকে ফসল কে রক্ষা করতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা আবশ্যক।
ফসল কাটা: ফসল পেকে গেলে সেটিকে যত্ন সহকারে কেটে তুলে নিয়ে আসতে হবে।
স্টোরেজ: ফসল কাটা হয়ে গেলে সেগুলো যাতে খারাপ না হয়ে যায় তার জন্য নির্দিষ্ট রাখার জায়গা করতে হবে।
উপসংহার | Conclusion
পরিশেষে বলা যায় যে পুরোপুরিভাবে আধুনিক কৃষিকে একেবারেই বন্ধ করা যাবে না, তাই ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থাকে আরও ফলপ্রসূ করতে হবে।ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে বোঝা যাবে এই জৈবিক কৃষিই পারে আমাদেরকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সে জন্যও ধীরে ধীরে সবাইকে এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
আমরা এখানে যতটা সম্ভব জৈব কৃষির কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করেছি, আরো ভালো করে জানতে আপনি পরিচিত স্থানীয় কোন কৃষকের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন। আশা করছি আপনারা বুঝতে পেরেছেন যদি আপনাদের কোন রকম বুঝতে অসুবিধা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন।
এরকম কৃষি সম্পর্কিত নিত্য নতুন সহজ ভাষায় নিবন্ধের জন্য জন্য আমাদের এই ওয়েবসাইটকে ফলো করুন এবং আমরা আপনার সাহায্য করতে পেরে খুবই আনন্দিত।