জৈব কৃষি বা অর্গানিক ফার্মিং এর প্রকার এবং পদ্ধতি | Types of Organic Farming in Bengali 2024

বর্তমান সময়ের সব থেকে বড় সমস্যা হল জনসংখ্যার বৃদ্ধি, আর এই বৃদ্ধির চাহিদার মেটাতে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে কৃষিকাজ। ফলন বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম কৃষিতে অনেক ধরনের কীটনাশক, রাসায়নিক সার, অম্ল পদার্থ প্রভৃতির ব্যবহার করা হচ্ছে। যার জন্য শস্যের পরিমাণ বেড়ে গেলেও শস্যের গুণগত মান কিন্তু অনেক কমে যাচ্ছে।

কৃত্রিম পদ্ধতিতে তৈরি বিভিন্ন রকমের (কার্বাইড এর সাহায্যে পাকানো ফল, হাইব্রিড শাকসবজি, ব্রয়লার মুরগির মাংস) অপুষ্টিকর খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে। যে খাবার গুলি আমাদের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয় এগুলি বরং আমাদের অনেক ক্ষতি করে শরীরে বিভিন্ন রোগের দেখা দেয়।

এই ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল অর্গানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষি পদ্ধতি। এই কৃষিতে কৃত্রিম জিনিসের পরিবর্তে প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করা হয় যা থেকে কোনো ক্ষতি হয় না। বর্তমান সময়ে বহু কৃষক এই পুরনো পদ্ধতির আবার ব্যবহার শুরু করেছে, যার ফলে ধীরে ধীরে কৃষিকাজে অগ্রগতি দেখা দিয়েছে।

তো আমরা এই নিবন্ধের মাধ্যমে আজকে অর্গানিক ফার্মিং এর সম্পর্কে ভালো করে জানতে পারবো, তাই বেশি দেরি না করে আমাদের মূল বিষয়টি শুরু করা যাক।

অর্গানিক ফার্মিং কী? What is organic farming?

দর্শকের মনে এবার প্রশ্ন আসবে যে এই organic farming জিনিসটা কি? তো আমি বলে দিচ্ছি এই জিনিসটি হল সহজ কথায় প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি। যেটি আদি কাল থেকে চলে আসছে মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল তখন তারা এই পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে থাকতো, যেমন ভেষজ উদ্ভিদ কে কীটনাশক, গবাদি পশুদের মল মূত্র কে সার রূপে ব্যবহার করে। আর এই কোনরকম কৃত্রিম ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে জৈব পন্থা অবলম্বন করে ফলন করাকেই বলা হয় অর্গানিক ফার্মিং।

হ্যাঁ তবে প্রাচীন কালে যেমন ছিল বর্তমান সময়ে তার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, কারণ মানুষ এখন শিক্ষিত হওয়ায় নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছে ও এই কৃষি পদ্ধতি অনেক এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে নিত্যদিনের বিভিন্ন জিনিসপত্র যেমন দুধ, মাছ, মাংস, শাক সবজি প্রভৃতি ক্ষেত্রে  organic products এর চাহিদা অনেক বেশি। এই organic farming এ উৎপাদন কম হলেও এর উপকারিতা এবং গুনাগুন  অনেক পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়।

অর্গানিক ফার্মিং এর ধরন | Types of organic farming

 কৃষিতে জৈব পদার্থের ব্যবহার লক্ষ্য করে organic farming কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে । যথা- পিওর অর্গানিক ফার্মিং এবং ইন্টিগ্রেটেড অর্গানিক ফার্মিং, এই দুই ধরনের ফার্মিং সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –

১. পিওর অর্গানিক ফার্মিং | Pure organic farming

Pure organic farming নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এটি একেবারেই পুরোপুরি অর্গানিক জিনিস যেমন জৈব সার, পেস্টিসাইড, কীটনাশক এইসব ব্যবহার করে চাষ করা হয়ে থাকে। এই ফার্মিং পদ্ধতিতে সেখানের মাটি, জল এবং বায়ুর  যেমন কোনোরকম ক্ষতি হয় না, তেমন সেখানে যা যা পণ্য উৎপাদিত হয় সেগুলো খুবই পুষ্টিকর হয়।

কোন রকম কেমিক্যাল বা হার্মফুল প্রোডাক্ট এখানে ব্যবহার করা হয় না, তাই শস্য উৎপাদনে সময় বেশি লাগে। তবে এটা বলা যেতে পারে এই পদ্ধতিটি আগামী দিনে ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

২. ইন্টিগ্রেটেড অর্গানিক ফার্মিং| Integrated organic farming

এই farming পদ্ধতিটিতে পুরোপুরি অর্গানিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় না, এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম এবং জৈব দুই ধরনের পদার্থের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যার ফলে এতে উৎপাদনও ভালো মাত্রায় হয় এবং পুষ্টিগুণও বজায় থাকে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে।

এই কৃষি পদ্ধতিতে প্রধানত জৈব পদার্থের ব্যবহার করা হয় এবং দরকার মতো সীমিত মাত্রায় কৃত্রিম পদার্থের ব্যবহার করা হয় যাতে সমতা বজায় থাকে। এই পদ্ধতিটি pure organic farming এর থেকে বেশি লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা এটি করতে বেশি আগ্রহ দান করে।

জৈব কৃষির চাহিদা, কাজের ভিত্তি, উৎপাদনের পরিমাণ ও লাভ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে এটি কে তিন ভাগে ভাগ করা যায় যথা সহজ জৈব কৃষি, বৃহত্তর জৈব কৃষি এবং আন্তর্জাতিক জৈব কৃষি। নিচে সেই সম্পর্কিত আলোচনা করা হলো –

১. সহজ জৈব কৃষি

এই জৈব কৃষি যেখানে কৃত্রিম কীটনাশক, সার এবং অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করা হয় না। এখানে বিভিন্ন উপকারী জীবাণু এবং প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার করা হয় যাতে মাটির উর্বরতা এবং পরিবেশের জীববৈচিত্র্য বজায় থাকে।

২. বৃহত্তর জৈব কৃষি

এই প্রকারের জৈব কৃষিতে বিশেষভাবে জীবাণু এবং পুষ্টিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় যা মাটির উর্বরতা এবং প্রাকৃতিক উপকরণের মাধ্যমে ফলনের বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে। বড় অঞ্চল জুড়ে চাষ করা হয়, সাথে কৃত্রিম পদার্থ ব্যবহার হয় বলে এতে উৎপাদনও বেশি হয় অনেকটা।

৩. আন্তর্জাতিক জৈব কৃষি

আন্তর্জাতিক জৈব কৃষিতে বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে তৈরি জীবাণু, পুষ্টিকর রাসায়নিক, এবং প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার করা হয় খাদ্য উৎপাদনের জন্য। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মাটির জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সাহায্য করে এই পদ্ধতি।

C. উৎপাদিত পণ্যের ও প্রতিপালনের ভিত্তিতে জৈব কৃষিকে ( organic farming) আবার চার ভাগে ভাগ করা যায়, যথা– শাক, আনা, মাছ এবং মাংস। এইগুলির সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো

১. ভেষজ ও  শাক

 Organic farming পদ্ধতির সবথেকে ভালো ফল পাওয়া যায় কুলেখাড়া, ধনে, নটে, ব্রাম্হী, কালমেঘ, পুদিনা প্রভৃতি শাকের চাষে। এই ফার্মিং পদ্ধতিতে একসঙ্গে একদিকে যেমন শস্য চাষ করা যায় তেমনি সাথে সাথে এই শাকের চাষ ও করা হয়, ফলে মাটির জৈব মাত্রা বজায় থাকে।

২. আনাজ বা ভেজিটেবল

একই জমিতে বছরে দুই থেকে তিনবার বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়, ধান তোলা হয়ে গেলে সেই সময় জমিতে বিভিন্ন ধরনের তৈল বীজ, সূর্যমুখী, তিল ইত্যাদি চাষ করা হয়। ফলে কৃষকরা অধিক লাভের মুখ দেখে আবার এমন কিছু কিছু সবজি আছে যারা মাটিতে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন এর যোগান বাড়ায়। জৈবিক উপায়ে ফলনের বৃদ্ধি হতে একটু দেরি হওয়ায় ধৈর্য রাখতে হবে তবে উৎপাদিত পন্য হবে একেবারে বিষমুক্ত।

৩. পশুপালন

অর্গানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন রকমের পশু পাখিরও চাষ করা যেতে পারে যেমন কোয়েল, মুরগি, হাঁস, গোরু, ছাগল, মোষ ইত্যাদি। পাখিদের চাষ করা হয় ডিম ও মাংসের জন্য, আর গবাদি পশু ছাগল, গরু, মহিষ প্রভৃতি চাষ করা হয় দুধ, ঘি, মাখন ও মাংসের চাহিদা মেটাতে। আবার এইসব পশুদের মলমূত্র যা বের হয় তা জৈব সার রূপে এবং কীটনাশক রূপেও জমিতে ব্যবহার করা হয় যার ফলে কৃষকের খরচা বেঁচে যায়।

৪. মৎস্য চাষ

মাছ চাষ ও করা হয়ে থাকে এই অর্গানিক ফার্মিং পদ্ধতিতে, এটিকে অত্যন্ত লাভবান একটি চাষ বলা যেতে পারে। একটি পুকুরের মধ্যে একসাথে অনেক ধরনের রকম মাছ চাষ করা যেতে পারে, হ্যাঁ কিন্তু মনে রাখতে হবে যদি চিংড়ি চাষ করা হয় তাহলে চিংড়ি গুলোকে আলাদা রাখতে হবে। বাঙালিদের কাছে মাছ একটি নিত্যদিনকার জিনিস কারণ মাছের ভাতে বাঙালি, তাই এই মাছ চাষ থেকে অনেক লাভ হয়ে থাকে সাথে এগুলো বিষমুক্ত হয়।

অর্গানিক ফার্মিং এর কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য

১. অর্গানিক ফার্মিং এ রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আগাছা নাশক প্রকৃতির ব্যবহার থেকে বিরত থাকা হয় যেটি অনেক ভালো একটি পদক্ষেপ আগামী দিনের জন্য।

২.  এর মূল পদ্ধতি শস্যাবর্তন, জৈব সার, জৈব বর্জ্য এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা তাই এতে শস্যের গুনাগুন খারাপ হয় না।

৩. মাটিতে জৈব পদার্থ তথা হিউমাসের পরিমাণ বৃদ্ধি হয় যার ফলে মাটির উর্বরতা, জল ধারণ ক্ষমতা এবং ভৌমজলের পরিমাণ বেড়ে যায়।

৪. কৃষকরা খুব সহজেই এই কৃষি পদ্ধতিটি শিখতে পারে, উৎপাদন খরচও অনেক কমিয়ে দেয় এবং পুষ্টিকর পণ্যও উৎপাদন করা যায়।

FAQs. অর্গানিক ফার্মিং পদ্ধতি

১. আমাদের দৈনন্দিন জীবনে জৈব চাষের ভূমিকা কী?

বর্তমানের কৃষি ব্যবস্থায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, ভূমি ক্ষয়, জল দূষণের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে এবং মানুষের শরীরে তার ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেই জন্য জৈব চাষ একান্ত দরকার। জৈব চাষ কার্বন নিঃসরণ কমায়, মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং বিপজ্জনক কীটনাশকের হাত থেকে বাঁচায় যার ফলে পুনরায় সুন্দর পরিবেশ ফিরে আসবে।

২. জৈব চাষ কি আধুনিক কৃষিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে?

এটাই এখন কৃষির অনিবার্য ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জৈব চাষ শুধুমাত্র একটি উৎপাদন পদ্ধতি নয় বরং এমন এক নিদর্শন স্থাপন করেছে যা কৃত্রিম সার, কীটনাশকদের ব্যবহার কমিয়েও সফলতা পেয়েছে।

৩. জৈব চাষ কেন প্রয়োজন?

এটি দূষণের মাত্রা কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি পণ্যের অবশিষ্টাংশের মাত্রা হ্রাস করে মানব ও প্রাণীর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কেও অনেক হ্রাস করে। এটি কৃষি উৎপাদনের খরচ কমায় এবং মাটির স্বাস্থ্যও উন্নত করে।

উপসংহার

এই ভিন্ন প্রকারের জৈব কৃষির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন এবং পরিবেশের সুরক্ষা উন্নত করা সম্ভব হবে। এই কৃষি পদ্ধতি বিশেষ ভাবে স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদন করার জন্য সাহায্য করে। এখন হয়তো এই কৃষি ব্যবস্থার তেমন চল নেই কিন্তু ভবিষ্যৎ কে মাথায় রেখে আমাদেরকে এই কৃষি অবস্থাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

পুরোপুরিভাবে আধুনিক কৃষিকে একেবারেই বন্ধ করা যাবে না, তাই ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থাকে আরও ফলপ্রসূ করতে হবে। অনেক ধরনের জৈব কৃষির কথা এখানে বলা হলো আপনি আপনার পছন্দ মতন জৈব কৃষি আজই শুরু করতে পারেন। এই ছোট ছোট শুরু থেকেই পরবর্তীকালে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে।

আমাদের এই নিবন্ধ আপনার কোন রকম সাহায্য করে থাকলে আমরা খুবই আনন্দিত হব এবং কোনরকম প্রশ্ন থাকলে অতি অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাবেন।

Leave a Comment