বিভিন্ন জলবায়ুতে ভুট্টা চাষ Vutta Chas করা যায়। তবে, রবি মৌসুম (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) এবং খরিফ মৌসুম (জুন-আগস্ট) ভুট্টা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময়। ভালো ফলনের জন্য জমি নির্বাচন, বীজ নির্বাচন, বীজ বপন, সার প্রয়োগ, সেচ, আগাছা দমন, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ এবং কাটা-মাড়াইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সঠিক যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টাতে আমিষ জাতীয় উপাদান বেশি থাকে। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামিনো এসিড, ট্রিপটোফ্যান, লাইসিন অধিক পরিমাণে ভুট্টা তে পাওয়া যায়। এই আর্টিকেল টিতে আমরা ভুট্টা চাষের প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত বিবরণ এবং প্রতিটি ধাপে কৃষকদের জন্য কী করণীয় সে সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করবো। আমাদের লক্ষ্য হলো উন্নত ভুট্টা চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকদের উচ্চ ফলন পেতে সহায়তা করা এবং ভুট্টা চাষকে আরও লাভজনক করে তোলা।
ভুট্টা চাষের জন্য জমি ও মাটি নির্বাচন
বেলে-দোআশ মাটি ভুট্টা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এই মাটিতে সহজে জলনিকাশ হয় এবং পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে।
pH মাত্রা
মাটির pH 5.5 থেকে 6.5 হলে ভুট্টা ভালো জন্মায়। এই ধরনের মাটি ভুট্টা চাষের জন্য উপযুক্ত।
জলনিকাশি ব্যবস্থা
জমিতে জল জমতে না দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে গাছের শিকড় পচে যেতে পারে। তাই ভুট্টা চাষের ক্ষেত্রে জমির জলনিকাশী ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে।
উর্বরতা
মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জৈব সার ব্যবহার করা উচিত। অধিক উর্বর জমিতে ভুট্টা চাষ ভালো হয়।
জমি প্রস্তুতি
মাটি প্রস্তুত
ভালো ফলনের জন্য জমি আগে থেকে ভালোভাবে চাষ করে প্রস্তুত করা উচিত।
জমি পরিষ্কার
জমি থেকে আগাছা, পাথর এবং অন্যান্য অনাবশ্যক বস্তু সরিয়ে ফেলতে হবে।
সার ব্যবহার
মাটির উর্বরতা বাড়াতে গোবরের সার, কম্পোস্ট ইত্যাদি জৈব সার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজন হলে রাসায়নিক সারও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভুট্টা চাষের অতিরিক্ত কিছু টিপস
- স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ নিয়ে ভুট্টা চাষ করা।
- উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার করা।
- আধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগ করা।
- নিয়মিত পরিচর্যা করা।
ভুট্টার জাত নির্বাচন
উচ্চ ফলনশীলতা
সঠিক জাত নির্বাচন করলে প্রতি ইউনিট জমিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উন্নত জাতগুলো রোগ-প্রতিরোধী এবং অনুকূল আবহাওয়ায় ভালো ফলন দেয়। উদাহরণস্বরূপ, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, জাউরি-১ এর মতো জাতগুলো উচ্চ ফলনশীল এবং বিভিন্ন আবহাওয়ায় খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধ
উন্নত জাতগুলো বিভিন্ন ধরণের রোগ ও পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধী ক্ষমতার অধিকারী হয়। ফলে কীটনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিকের ব্যবহার কমে যায়, যা পরিবেশের জন্য ভালো এবং উৎপাদন খরচও কমে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া
আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত জাতগুলো শুষ্ক এবং উষ্ণ আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারে এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
জমির ধরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ
বিভিন্ন ধরণের জমিতে বিভিন্ন ধরণের ভুট্টার জাত ভালো ফলন দেয়। উদাহরণস্বরূপ, বালিয়াড়ি, চাষাবাদযোগ্য জমি এবং নিম্নভূমি -এর জন্য আলাদা আলাদা জাত নির্বাচন করা উচিত।
কিছু উন্নত জাতের ভুট্টার উদাহরণ
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, জাউরি-১, জাউরি-২, জাউরি-৩, হাইড্রিড-১, হাইড্রিড-২ ইত্যাদি।
ভুট্টার বীজ বপন পদ্ধতি | Vutta Chas Poddhoti
উপযুক্ত সময়
খরিফ মৌসুম: জুন-জুলাই
রবি মৌসুম: অক্টোবর-নভেম্বর
আরো পড়ুন: অর্গানিক খাবারের উপকারিতা
ভুট্টা বীজ বপনের পদ্ধতি
জমি প্রস্তুতি
ভুট্টা চাষের জন্য জমি ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। কম্পোস্ট বা গোবরের মতো জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। ইউরিয়া, টিএসপি, মিউরিয়েট অফ পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। সমতট জমি ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী।
বীজ নির্বাচন
উন্নত জাতের ভুট্টা বীজ বেছে নেওয়া উচিত।
স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ নিয়ে বীজ নির্বাচন করতে হবে। বীজ রোগমুক্ত এবং জীবাণুমুক্ত হতে হবে।
বীজ বপন
ভুট্টার বীজ বপন করার কিছু নিয়ম আছে, সেগুলো হলো,
- সারির দূরত্ব 60-75 সেমি রাখতে হবে।
- গাছের দূরত্ব 20-25 সেমি রাখতে হবে।
- প্রতিটি গর্তে 2-3টি বীজ বপন করা যেতে পারে।
- বীজ বপনের গভীরতা 3-5 সেমি হওয়া উচিত।
বীজ বপনের পর
- বীজ বপনের পর হালকা সেচ দিতে হবে।
- মাটির পর্যাপ্ত আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে।
- অঙ্কুরিত হওয়ার পর অতিরিক্ত চারাগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
- আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
- প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে।
- পোকাকামাকড় ও বিভিন্ন রোগ থেকে ফসল রক্ষা করতে হবে।
ভুট্টার বীজ বপন করার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো
- বীজ বপনের আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে নেওয়া উচিত।
- বৃষ্টির সময় বীজ বপন করা ঠিক নয়।
- জমিতে যেন জল জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি।
- প্রয়োজনে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
উপযুক্ত সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে বীজ বপন করলে ভুট্টা চাষে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো মেনে চললে ভুট্টা চাষে সফলতা অর্জন করা যাবে।
সার প্রয়োগ
ভুট্টা চাষে ভালো ফলন নিশ্চিত করতে সঠিক পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বীজ বপন করার পর সঠিক ভাবে সার প্রয়োগ করতে হবে।
মাটি পরীক্ষা
ভুট্টার বীজ বপনের আগে মাটির নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি নির্ণয় করতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রকার নির্ধারন
মাটি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সারের প্রকার ও পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
সারের প্রকার ও পরিমাণ
জৈব সার
পচা গোবর সার, কম্পোস্ট সার, সবুজ সার ইত্যাদি ভুট্টার জমিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রাসায়নিক সার
ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিংক সালফেট, বোরন ইত্যাদি।
প্রয়োগের সময়
বীজ বপনের আগে জমিতে জৈব সার প্রয়োগ।
চারা গজানোর সময় প্রথমবার রাসায়নিক সার প্রয়োগ। দ্বিতীয়বার রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে চারা গজানোর ৩০-৩৫ দিন পর। চারা গজানোর ৬০-৭০ দিন পর তৃতীয়বারের মতো রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে।
আগাছা দমন
ভুট্টা চাষে আগাছা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আগাছা ফসলের পুষ্টি শোষণ করে।
আগাছা দমনের পদ্ধতি
নিড়ানী
হাত দিয়ে বা কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করে আগাছা তুলে ফেলা।
মাটি চাষ
বীজ বপনের আগে এবং চারা গজানোর পর মাটি চাষ করে আগাছা দমন।
রাসায়নিক আগাছানাশক
অনুমোদিত ও পরিবেশবান্ধব আগাছানাশক ব্যবহার করে আগাছা দমন করা।
আরো পড়ুন: কৃষক বন্ধু স্কিম
আন্তঃচাষ
ভুট্টার সাথে সয়াবিন, মুগ, ছোলা, কলাই ইত্যাদি ফসল আন্তঃচাষ করে আগাছা দমন করা যেতে পারে।
টিপস
- স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ নেওয়া।
- পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সার ও আগাছানাশক ব্যবহার করা।
- সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নিরাপত্তা বিধি মেনে আগাছানাশক ব্যবহার করা।
ভুট্টা চাষের জন্য জলসেচ পদ্ধতি
ভুট্টা চাষের সঠিক ফলন নিশ্চিত করতে জলসেচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট সময়ে এবং পরিমাণে জলসেচ ফসলের বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
জলসেচের সময়
- বীজ বপনের পর মাটি আর্দ্র রাখতে প্রথম জলসেচ জরুরি।
- চারাগাছের দ্রুত বৃদ্ধির সময় (বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ পর) দ্বিতীয়বার জলসেচ করতে হবে।
- ফুল আসা ও দানা তৈরির সময় (তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহ) নিয়মিত জলসেচ প্রয়োজন।
পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ
ভুট্টা চাষে পোকামাকড়ের আক্রমণ ফসলের উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পোকামাকড় ও তাদের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি,
বোরার
বোরার গাছের ডাঁটা ও পাতায় আক্রমণ করে। কার্বারিল বা ফিপ্রোনিল কীটনাশক ব্যবহার করে বোরার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
ময়লা
ময়লা পাতায় আক্রমণ করে এবং গাছের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। ময়লা নিয়ন্ত্রন করার জন্য ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল বা ইমিডাক্লোপ্রিড কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
থ্রিপস
থ্রিপস পাতার রস চুষে নেয়। স্পিনোসাড বা অ্যাসিফেট কীটনাশক ব্যবহার করে থ্রিপস নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
রোগ নিয়ন্ত্রণ
ভুট্টা চাষে বিভিন্ন রোগ ফসলের উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ভুট্টার কিছু গুরুত্বপূর্ণ রোগ ও তাদের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি,
পাতা পচা রোগ
গাছের পাতায় আক্রমণ করে এবং পচিয়ে ফেলে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ ও রোগ প্রতিরোধী ঔষুধ ব্যবহার করতে হবে।
শীষ পচা রোগ
ভুট্টার শীষে আক্রমণ করে। রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ ও রোগ প্রতিরোধী ঔষুধ ব্যবহার করতে হবে।
ডান্ডা পচা রোগ
ডান্ডা পচিয়ে ফেলে। প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার ও রোগ প্রতিরোধী ঔষুধ ব্যবহার করতে হবে।
আরো পড়ুন: কম খরচে কৃষি
উপসংহার
ভুট্টা চাষ একটি লাভজনক এবং বহুমুখী কৃষি কার্যক্রম। সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে এবং সঠিক গুণগত মান বজায় রেখে ফসলটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। সুতরাং ভুট্টা চাষের সঠিক পদ্ধতি ও উপকরণের সঠিক ব্যবহার কৃষকদের আয় বাড়ানোর সাথে সাথে ভুট্টা চাষের উন্নতিতে সাহায্য করবে।